শাড়ির সঠিক যত্ন–
শাড়িতেই নারী, আর এতেই প্রকাশ পায় নারীর প্রকৃত সৌন্দর্য্য। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাশনের পরিবর্তন হয়েছে। তবে এখনও নারীদের অন্যতম পছন্দের পোশাক শাড়ি। সুতি, লিনেন, হ্যান্ডলুম, সিল্ক, যেকোনো রকমের শাড়িই হোক না কেন, ঠিকমতো পরলে ভিড়ের মধ্যেও আপনি চোখ টানবেন। তাই কিশোরী থেকে মধ্যবয়স্ক, অফিসে, অনুষ্ঠানে সবার পছন্দের পোশাক শাড়ি। প্রতিটি মেয়ের আলমারিতে আর কিছু থাকুক বা না থাকুক শাড়ি থাকবেই। তবে আলমারিতে রেখে দিলেই শাড়ি ভালো থাকবে এমন নয়, তাকে ভালো করে রাখতেও হবে। নয়তো সাধের শাড়ির হাল খারাপ হতে সময় লাগবে না একটুও। শাড়ি ভালো রাখতে প্রয়োজন আলাদা যত্নের। বেনারসি কিংবা জামদানি, কাতান কিংবা টিস্যু বা সিল্ক- দীর্ঘদিন ভালো রাখতে দরকার সব শাড়ির চাই সঠিক যত্ন। আপনার যত্নেই শাড়ি সুন্দর থাকবে বহুদিন।
চলুন জেনে নেই কোন শাড়ির জন্য কেমন যত্ন প্রয়োজন-
সুতি শাড়িঃ
সুতি শাড়ি পরিষ্কার ও সংরক্ষণে তেমন কোনো ঝামেলা নেই। ঘরেই সুতি শাড়ি পরিষ্কার করা যায়। ঠান্ডা কিংবা হালকা গরম জলে ডিটারজেন্ট মিশিয়ে দশ থেকে পনের মিনিট ভিজিয়ে রেখে ধুয়ে ফেললেই হয়। তবে রঙিন শাড়িতে গরম জল ব্যবহার না করাই ভালো। তাতে শাড়ির উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে যায়। সুতি শাড়ি ধুয়ে মাড় বা এরারুট দিয়ে ইস্ত্রি করে নিলে ভালো থাকে। তবে অনেকদিনের জন্য তুলে রাখতে চাইলে মাড় না দেয়াই ভালো।
কোরা, অর্গানজাস ও চান্দেরিঃ
এই শাড়িগুলোকে লম্বা কাঠের লাঠিতে পেঁচিয়ে রাখতে হবে। মুড়িয়ে রাখতে হবে মলমল কাপড়ে। সংরক্ষণ করতে অনেকগুলো শাড়ির নিচে সমতল স্থানে। কিছুদিন পর পর ভাঁজ খুলে নতুন করে ভাঁজ করতে হবে যাতে ভাঁজে ভাঁজে ছিড়ে না যায়। এই শাড়িগুলো কখনই দীর্ঘদিন হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখা যাবে না।
টিস্যুঃ
এই ধরনের শাড়িগুলো সবসময় বেনারসি শাড়ির কারিগরদের হাতে পরিষ্কার করানো নিরাপদ। কারণ সাধারণ ড্রাই ক্লিনিংয়ে শাড়িতে ভাঁজ পড়ে যেতে পারে। আর বেনারসি কারিগররা পরিষ্কার রবে লম্বা টেবিলের উপর রেখে।
শিফনঃ
অন্যান্য শাড়ির তুলনায় শিফন শাড়ির চাই বাড়তি যত্ন। শিফন কিংবা জর্জেটের শাড়িতে রোলার আয়রন ব্যবহার করবেন কি না তা সম্পূর্ণ আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কড়া রোলার আয়রন দামি শিফন শাড়ির স্বাভাবিক ভাঁজ দূর করে। তবে কমদামি শিফন শাড়িতে সচরাচর ভাঁজ থাকে না, তাই এতে ভাঁজ ভাঁজ আনার জন্য হালকা রোলার আয়রন আবশ্যক।
তাঁত ও টাঙ্গাইল শাড়িঃ
এধরনের শাড়ি ড্রাই ওয়াশ করালে শাড়ি বেশিদিন ভালো থাকে। বাড়িতে ধোয়ার সময় ভুলেও শাড়ি ওয়াশিং মেশিনে দেবেন না। ভালোমত শুকিয়ে আয়রণ করে তুলে রাখুন। মাঝেমধ্যে উপরের শাড়ি নিচে এবং নিচের শাড়ি উপরে উঠিয়ে উল্টেপাল্টে রাখুন।
জামদানি শাড়িঃ
কখনোই ঘরে জামদানি শাড়ি ধুয়ে নিতে যাবেন না। এই শাড়ি বিশেষ প্রক্রিয়ায় পরিষ্কার করতে হয় যা কাটা ওয়াশ নামে পরিচিত, তাই এটি লন্ড্রিতে বা তাতীদের দিয়ে ওয়াশ করানোই উত্তম। জামদানি শাড়ি ভাঁজ করে রাখবেন না। এতে ভাঁজে ভাঁজে শাড়ি কেটে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়। সবসময় হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখুন কিংবা রোলারে পেঁচিয়ে রাখুন। এতে শাড়িতে ভাঁজ পরবে না। তাই আপনার পছন্দের জামদানি শাড়ির সঠিক যত্ন নিন।
কাতান ও বেনারসি শাড়িঃ
এই শাড়িগুলো ক্যালেন্ডার ওয়াশ পদ্ধতিতে পরিষ্কার করা হয়। এই শাড়িগুলোও জামদানির মতন ভাঁজ করে রাখা যাবে না। হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। নিতান্তই না পারলে হালকা ভাঁজে রাখতে পারেন। তবে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখলে বা হালকা ভাঁজে রাখলেও শাড়িতে ভাঁজের দাগ পরে যায়। তাই কিছুদিন পরপর শাড়ি বের করে রোদে দিয়ে ভাঁজ পালটে রাখুন।
মণিপুরী শাড়িঃ
মণিপুরী শাড়ি দু-তিনবার ব্যবহারের পর ওয়াশ করে নেওয়া ভালো। খুব যত্ন নিয়ে হালকা ডিটারজেন্ট বা শ্যাম্পু দিয়ে ওয়াশ করবেন। কচলাবেন না। শাড়ি শুকনোর জন্য ঝুলিয়ে দেবার সময় দুটো পাশেই সমান করে ঝুলিয়ে দেবেন। নয়ত শাড়িটা বাঁকা হয়ে যেতে পারে।
এছাড়াও কিছু ছোটখাটো পদ্ধতি অনুসরণ করে শাড়ির সঠিক যত্ন করলে সারা বছর শাড়ির সৌন্দর্য অক্ষুন্ন রাখা সম্ভব-
- ডিটারজেন্টের চাইতে ড্রাই ক্লিনিং ভালো। বিকল্প হিসেবে শ্যাম্পু কিংবা শ্যাম্পু ও ডিটারজেন্টের মিশ্রণ ব্যবহার করতে পারেন।
- শাড়ি সরাসরি সূর্যের আলোতে শুকানো যাবে না। এতে রং নষ্ট হয়ে যাবে।
- কড়া দাগ তুলতে ড্রাই ওয়াশের বিকল্প হিসেবে পেট্রোল ব্যবহার করতে পারেন। নেইল পলিশের দাগ তুলতে অ্যাসিটোন ব্যবহার করতে পারেন। তেলের দাগ তুলতে ধোয়ার আগে ট্যালকম পাউডার ও সামান্য ডিটারজেন্ট দাগে উপর ঘষে নিতে পারেন।
- ভারি কারুকাজের শাড়ি ভালো রাখতে সবসময় শাড়ির উল্টা দিকটা বাইরের দিকে রেখে ভাঁজ করা উচিত।
- শাড়িতে সরাসরি সুগন্ধি দ্রব্য ছড়ালে স্থায়ী দাগ পড়ে যেতে পারে। তাই কবজিতে সুগন্ধি মাখাই নিরাপদ।
- শাড়ি সবসময় মৃদু থেকে মাঝারি তাপমাত্রায় আয়রন করা উচিত। বেশি তাপ হলে শাড়িতে ছাপ পড়ে যেতে পারে।
- পোকামাকড় থেকে বাঁচাতে শাড়ির আশপাশে ন্যাপথালিন বল না রেখে নিম পাতা ব্যবহার করতে পারেন।
- পরিপাটি ভাঁজ শাড়ীকে অনেকদিন নতুন রাখে।
- কোন একটা ভাল শাড়ী ছাড়ার পরপরই ভাঁজ করে তুলে রাখবেন না। একটু রোদে শুকিয়ে বা ফ্যানের তলায় শুকিয়ে ইস্ত্রি করে আলমারিতে তুলে রাখবেন।
- আপনার যত দামী শাড়ী আছে যেমন সিল্ক, রেশম , পাট, মুগা, বেনারসী, পশমিনা, টিস্যু, জামদানী ইত্যাদিকে লম্বা ভাঁজ করে একটা পরিষ্কার মলমলের কাপড় দিয়ে জড়িয়ে রাখো একটা তাকে পেতে রাখো।
- আলমারি গুছিয়ে রাখার পদ্ধতি ঠিক থাকলে শাড়ী অনেকদিন ভালো থাকে। ঠাসাঠাসি করে শাড়ী রাখা একদমই ঠিক না। আলমারির মধ্যে হাওয়া খেলার একটু জায়গা তো রাখতে হবে।
- শাড়ি ধাতব হ্যাঙ্গারে রাখা উচিত নয়, মরিচার দাগ লেগে যেতে পারে। যদি হ্যাঙ্গার ব্যবহার না করেন তবে একটার উপর আরেকটা রাখতে পারেন এক ভাঁজে। বেশি ভাঁজ দিলে কাপড় কিংবা কারুকাজের সেলাই একটার সঙ্গে আরেকটা লেগে যেতে পারে। ফলে শাড়ি নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে।
- আলমারির হ্যাঙার শক্তপোক্ত কিনবেন যাতে রডটা শাড়ীর ভারে কেতরে না পড়ে। বাজে হ্যাঙারে শাড়ী বেশীদিন সুস্থ অবস্থায় থাকে না। কাঠের বা শক্ত প্লাস্টিকের হ্যাঙার ভালো। খসখসে হ্যাঙারে কখনও শাড়ী ঝুলিও না। দুটোর বেশী শাড়ী একটা হ্যাঙারে রেখো না। ইস্ত্রি খারাপ হয়ে যায়।
- ভাল শাড়ী পানি দিয়ে ধোবেন না। দোকানে স্টিম প্রেস করাবেন। আলমারিতে ইস্ত্রি না করে কোন শাড়ী রাখবেন না। শাড়ীর সাথে জার্মস ওখানে ঢুকে গেলে ধীরে ধীরে শাড়ী নষ্ট হওয়া শুরু হবে।
- শাড়ী কোন কারণে ছিঁড়লে তৎক্ষণাৎ রিফু করিয়ে নিন। যত দেরি করবেন তত নষ্ট হবে শাড়ীটা।
- মাসে একবার অন্তত আলমারি থেকে সব শাড়ী বের করে আবার গোছাবেন। বিশেষ করে মলমলে জড়ানো শাড়ীগুলো। মাঝেমাঝে ভাঁজ খুলে খুলে দেখবেন। ভাঁজ বদল করবে নয়তো অনেক সময় শাড়ী ভাঁজে ভাঁজে ফেঁসে যায়।
- শাড়ী অর্গেনাইজারে শাড়ী রাখতে পারবেন তবে খেয়াল রাখবেন সেটা যেন সুতীর কাপড়ের হয়। প্লাস্টিকের শাড়ী বা ব্লাউজ অর্গেনাইজার তেমন সুবিধের হয় না। কেমন যেন ভেতরটা গরমকালে ভেঁপসে ওঠে।
- নিমপাতা, কালোজিরে আর কারিপাতার আলাদা আলাদা ছোট ছোট কাপড়ের পুটলি বানিয়ে আলমারির বিভিন্ন খোপে রেখে দিন। তাহলে পোকামাকড় থেকে শাড়ীগুলো রক্ষা পাবে। নেফথালিন , অডোনিল রাখতে পারেন। অনেকে এসেন্সিয়াল অয়েল আলমারিতে রাখে। আলমারি খুললে একটা ফ্রেশ গন্ধ বেরোয় আর শাড়ীগুলোরও ফ্রেশ থাকে।
- বছরে একবার অন্তত সব শাড়ীকে সারা দিন রোদে দিন। ডাইরেক্ট রোদ নয় যদিও। ব্যালকনি থাকলে শাড়ীগুলোকে দড়িতে ঝুলিয়ে দিন। নীচে কোন কাপড় পেতে শাড়ীগুলোকে ছড়িয়ে রাখুন। ছাদ থাকলে আরো ভাল। ছাদে পাটি অথবা মাদুর পেতে বা এক দুটো বেডকাভার পেতে শাড়ী গুলোকে রেখে দিন। কড়া রোদের সময় একটা হালকা কাপড় দিয়ে শাড়ীগুলোকে ঢেকে রাখুন। সন্ধ্যের আগে গরমাগরম সবকটা শাড়ী আবার আলমারিতে তুলে রাখুন। সেদিন ভাঁজ বদলালে আরো ভালো হয়।
- শাড়িতে আলপিন কিংবা সেফটিপিন ব্যবহার না করাই শ্রেয়, বিশেষ করে শিফন শাড়িতে। তারপরও ব্যবহার করতেই হয়। তাই চেষ্টা করতে হবে পিনগুলো যাতে বেশি আঁটসাঁট অবস্থায় না থাকে। ভারী এব্রোয়ডারি কিংবা ভাড়ী পাড়ের শিফন শাড়ি হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখা উচিত নয়। কারণ একসময় ওই ভারী কাজের ভারেই শাড়ি ছিঁড়ে যেতে পারে।
- আজকাল দোকানে ময়েশ্চার অ্যাবজরবেন্টের ছোট্ট ছোট্ট প্যাকেট কিনতে পাওয়া যায়। বর্ষাকালে শাড়ীর আলমারিতে অবশ্যই রাখবেন।
- সুতি শাড়ি ধোয়ার পর অ্যারারুট দিয়ে নিন। এরপর টানটান করে মেলে দিন। শুকিয়ে গেলে ইস্ত্রি করে আলমারিতে তুলে রাখুন।
- জামদানি শাড়িকে কাটা ওয়াশ করতে হয়। এই শাড়ি আলমারিতে ভাঁজ করে রাখবেন না। হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখুন বা রোলারে পেঁচিয়ে রাখতে পারেন। ভাঁজ করে রাখলে জামদানি শাড়ির মাঝেমধ্যে কেটে যায়। শাড়ি দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।
- শিফনের শাড়ি কখনও ইস্ত্রি করবেন না, আলমারিতে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখবেন না। এই শাড়িতে সেফটিপিন ব্যবহার না করাই ভালো।
- চান্দেরি বা বেনারসি জাতীয় শাড়ি ভাঁজ করে রাখুন। সবচেয়ে ভালো হয় সরু লাঠি জাতীয় কোনো কিছুতে রোল করে রাখলে অথবা সাদা ট্রেসিং পেপার দিয়ে মুড়ে রাখলে। মাঝেমধ্যে শাড়ি অবশ্যই রোদে দেবেন।
- সিল্ক শাড়ি হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে আলমারিতে রাখুন। ড্রাই ওয়াশ করতে হবে। বাড়িতে ধোয়া যাবে না। এই শাড়ি উল্টো করে ইস্ত্রি করান। সিল্ক শাড়িতে দাগ পড়ে যায়। এক্ষেত্রে দাগের অংশে পাউডার দিয়ে রাখুন।
- তাঁতের শাড়ি আলমারিতে রাখার আগে আয়রন করে রাখুন। অনেকদিন পরা না হলে মাঝেমধ্যে খুলে ভাঁজ উল্টেপাল্টে নিন।
- মসলিন কাপড়ে মুড়িয়ে রাখলে বাজে দুর্গন্ধ ও ধুলাবালি থেকে দূরে থাকবে।
উপরোক্ত টিপসগুলো অনুসরণ করে শাড়ির সঠিক যত্ন নিলে পছন্দের শাড়িটি নতুনের মতোই সুন্দর থাকবে দীর্ঘদিন।
পোশাক বিষয়ক তথ্য পেতে জয়েন করুন আমাদের ফেইসবুক গ্রুপ এবং ফলো করুন আমাদের পেইজ